নিনজা নিঃশব্দ কালো আততায়ীদের ইতিহাস!
কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলেন আপনার দিকে ছুটে আসছে একটার পর একটা ব্লেড। ক্ষিপ্র তাদের গতি। ছয় ফলাওয়ালা চাকতির মতো ব্লেডগুলোর নামও আছে সুরিকেন (Shuriken) অথবা হুট করেই ছায়ার মত কাতানা (Katana) নামের লম্বা ব্লেড হাতে ঝাপিয়ে পড়লো কেউ।
কোথা থেকে এলো, কোথায় লুকিয়ে ছিলো কিছুই জানা যায় না। যদি দেখতেও পান কখনো তবুও দেখা যাবে শূধুই আগা গোড়া কালো পোশাকে ঢাকা মুখ, কেবল চোখ দুটি দেখা যায়। এই পোষাকেরও নির্দিষ্ট নাম আছে ইওরি বা আর্মার (ninja-yoroi or ninja armor) তারা মুহূর্তেই ছায়ায় হারিয়ে যেতে পারে, নিঃশব্দে দেয়াল বেয়ে উঠতে পারে। এক ছাদ থেকে লাফিয়ে যেতে পারে অন্য ছাদে। কালো আততায়ী তারা, যেনো কমিক্সের পাতা থেকে উঠে আসা। তাদের প্রতিটা পদক্ষেপই গা ছম ছম দৃশ্য। তারা এগিয়ে যায় বিড়ালের মতো নিঃশব্দে, আর আক্রমণ করে ক্ষিপ্র চিতার মতো। উদ্দেশ্য পূরণের সাথে সাথেই চুটকির মতো সামান্য বিস্ফোরকের ধোঁয়া। তাতেই হারিয়ে যায় নিমিষেই। শত খুজেও পাওয়া যায় না তাদের। ঠিক যেনো ভোগাবাজির মতো মিলিয়ে যায় হাওয়ায়। নিশ্চয় এতক্ষণে বুঝে গেছেন কাদের কথা বলছি আমরা। হ্যা। মধ্যযুগীয় জাপানের স্পেশালাইজড কিলার নিনজাদের কথাই বলছি। আমাদের আজকের টপিক কালো পোশাকধারী, মুখ ঢেকে রাখা আততায়ী নিনজাদের (Ninja) নিয়ে। মুল কাহিনীতে যাবার আগে আপনাদের স্বাগতম জানাচ্ছি বর্ণ লতার আরো একটি ব্লগে!
কারা ছিল এই নিনজা? কাজ কি ছিল তাদের? আসলে মধ্যযুগে জাপানে নিনজাদের মধ্যযুগের জাপানে নিনজাদের উদ্ভব ঘটে বিশেষ একটি উদ্দেশ্য! তারা সমাজের উচ্চ স্তরের নয় বরং নিচু কৃষক শ্রেণী থেকে উঠে এসেছিল!
সে কারণে মানুষের আগ্রহ যতটা না ছিল অভিজাতক সামুরাইদের (Samurai) প্রতি ততটাই উপেক্ষিত ছিল নিনজারা, ফলে তাদের ইতিহাসের বিবরণ কম বরং গল্পকথা বেশি প্রচলিত, নিনজা শব্দটা চৈনিক শব্দ নিনসা থেকে এসেছে, আমরা যেমন তাদেরকে নিনজা নামে চিনি কিন্তু জাপানে তারা সিনোবি (Shinobi 忍) নামে বেশি পরিচিত, সিনোবি শব্দের অর্থ অনেকটা (নিস্তব্ধে ছিনিয়ে নেওয়া) যা নিনজাদের কার্যক্রমের অনেকটাই ধারণা দিয়ে দেয়, নিনজা বা সিনোবি ছিল মধ্যযুগে জাপানিজ যুদ্ধের স্পেশালাইজড কিলার এবং গোপন এজেন্ট যারা মার্শাল আর্টের উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হিসেবে ছিল যা পরবর্তী সময়ে নিঞ্জুৎসু (Ninjutsu 忍術) বা নিনজা টেকনিক নামে পরিচিতি লাভ করে! এই বিশেষ বাহিনী ছদ্মবেশ ধারণে, শত্রুর অবস্থান নির্ণয় এবং অতর্কিত আক্রমণে ভয়াবহ পারদর্শী ছিল, সাধারণত তারা রাতে তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে ছায়ার মত চলাচল করত! তখন সামুরাই বাহিনী ছিল উচ্চপদস্থ ফলে তাদের সম্মানও ছিল আলাদা,
তাদের দিয়ে সব কাজ করানো সম্ভব হতো না ফলে প্রয়োজন হয়ে পড়ে একটা বিশেষ বাহিনীর যাদের দ্বারা নোংরা কাজগুলো করিয়ে নেওয়া সম্ভব, সেখান থেকেই প্রয়োজন হয় নিনজাদের! সে সময় জাপানে সামন্তপ্রভুদের নির্দেশে আইনের বাহিরে যুদ্ধ-বিগ্রহ পরিচালনা করা, গুপ্তচরবৃত্তি, নাশকতা ও গুপ্ত হত্যার মতো হিংসাত্মক কাজগুলো তাদের দ্বারা সংঘটিত হত! আশেপাশের মানুষ কোনভাবেই টের পেত না তাদের অবস্থান! মিশে থাকতো তারা আঁধারের মাঝে আধার হয়ে, এই বিশেষ ক্ষমতার জন্য নিনজাদের মানুষ ভয় পেত যমের মতো! নিনজাদের উদ্ধার খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে, তাদের বাছাই করা হতো অনেক দেখে শুনে, জাপানের সাধারন বিদ্যালয়ে তারা তারা পড়াশোনা করতে পারত না, তারা পড়ালেখা করতো বিশেষ স্কুলে, সেখানেই ছোটবেলা থেকে শুরু হয় তাদের ট্রেনিং, বিশেষ স্কুলে বিশেষ রকম রহস্যময় প্রশিক্ষণ এবং রহস্যজনক নামহীনতার কারণে নিন যারা নিজেরা হয়ে উঠতো রহস্যময়, আধুনিক কমিকস বা কম্পিউটার স্ক্রিনে আমরা তাদের যেমন দেখি ঠিক তেমন ছিলনা তারা! নিনজাদের উদ্ভবতির একদম সঠিক সময় কেউ বলতে পারে না, তবে নিনজাদের উদ্ভবতির সাথে চীনের সংশ্লিষ্টটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই! চীনে দর্শন খ্রিস্টাব্দে ব্যাপক অরাজগতা চলছিল, সে সময় বেশ কয়েকজন তৎকালীন সেনাপতি জাপানে চলে আসে, তারা জাপানেই থেকে যায় এবং সেখানকার পাহাড়ে বসতি স্থাপন করে, এই চৈনিক সেনাপতি দের সাথে আসে নতুন রণকৌশল ও যুদ্ধ দর্শন, এরপর অনেক চীনা সন্ন্যাসীরাও জাপানে আসতে থাকে, তাদের সাথে ছিল ভেষজ ও যুদ্ধ দর্শন, তাদের সাথে যোগ দেয় জাপানি সন্ন্যাসীরা তারা একে অপরের সমরকৌশল বিনিময় করে এক নতুন ধরনের দর্শন আবিষ্কার করে, এরাই প্রথম নিনজা গোত্র এদের যুদ্ধ কৌশলকে বলা হত নিঞ্জুৎসু, এ নিঞ্জুৎসু থেকেই নিনজাদের যুদ্ধ বিদ্যার উদ্ভব হয়েছিল,
শারীরিক এবং মানসিক প্রশিক্ষণ এর মধ্য দিয়ে নিনজাদের যেতে হতো! কেননা দীর্ঘপথ দৌড়ানো, পাহাড় পর্বত আরোহন, নিঃশব্দে হেঁটে চলা এবং অনেক সময় ধরে সাঁতার কাটার জন্য শারীরিক এবং মানসিকভাবে শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন ছিল, এই সাথে এরা চিকিৎসা ক্ষেত্রেও বিশেষ জ্ঞান রাখত, অনেকেই নিনজাদের সুপার হিউম্যান মনে করেন বিভিন্ন সিনেমা এবং কমিক বইয়ে কিন্তু সেটা একদমই ভুল ধারণা! তারা সাধারণ মানুষেই ছিল কিন্তু দক্ষতায় ছিল অসাধারণ! শুরুতে বিচ্ছিন্নভাবে শুরু করলেও ১৪ শতকের দিকে নিনজারা ধীরে ধীরে সখ্য বদ্ধ হতে শুরু করে ফলে ধীরে ধীরে সূচনা হয় বিখ্যাত নিনজা ক্লেনস: ইগা ক্লেন ও কোগা ক্লেন এর! (The Iga and The Koga clans)।
শারীরিক এবং মানসিক প্রশিক্ষণ এর মধ্য দিয়ে নিনজাদের যেতে হতো! কেননা দীর্ঘপথ দৌড়ানো, পাহাড় পর্বত আরোহন, নিঃশব্দে হেঁটে চলা এবং অনেক সময় ধরে সাঁতার কাটার জন্য শারীরিক এবং মানসিকভাবে শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন ছিল, এই সাথে এরা চিকিৎসা ক্ষেত্রেও বিশেষ জ্ঞান রাখত, অনেকেই নিনজাদের সুপার হিউম্যান মনে করেন বিভিন্ন সিনেমা এবং কমিক বইয়ে কিন্তু সেটা একদমই ভুল ধারণা! তারা সাধারণ মানুষেই ছিল কিন্তু দক্ষতায় ছিল অসাধারণ! শুরুতে বিচ্ছিন্নভাবে শুরু করলেও ১৪ শতকের দিকে নিনজারা ধীরে ধীরে সখ্য বদ্ধ হতে শুরু করে ফলে ধীরে ধীরে সূচনা হয় বিখ্যাত নিনজা ক্লেনস: ইগা ক্লেন ও কোগা ক্লেন এর! (The Iga and The Koga clans)।
মধ্যযুগে অন্তত ১৮ রকমের মার্শাল আর্টের চর্চা দেখা যায়, জুডো, জুডোট্সু, ইন্দো ইত্যাদি মার্শাল আর্টের চর্চা আজও প্রচলিত আছে! এই ১৮ রকমার মার্শাল আর্টের একটা ভাগ ছিল নিঞ্জুৎসু যা এডো পিরিয়ডের (Edo period) সময় ব্যাপক ভাবে বিকশিত হয়, এডো পিরিয়ড জাপানের ইতিহাসে ১৬০৩ থেকে ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত ধরা হয়! নিনজাদের মূল দায়িত্ব ছিল সরকারি আধিকারিকদের উপর কড়া নজর রাখা। তাদের জীবনধারা ছিল মূলত সামুরাইদের ঠিক বিপরীত! সামুরাইরা যেমন সুস্পষ্ট কোড মেনে সম্মানের সাথে জীবন যাপন করত এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সামনের সারিতে ঝাপিয়ে পড়তো কিন্তু নিনজাদের নির্দিষ্ট কোন সিস্টেম ছিলনা, উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যেকোনো ধরনের অসাধুপায় নিকৃষ্ট কাজ করতে তাদের বিবেককেও বাদত না, আসলে তাদের বিবেক বলতে কিছু ছিলোই না!
তারা ছিল ভারাটে যোদ্ধা, অর্থের জন্য যে কারো সাথে বেইমানি কিংবা যে কারো পক্ষে কাজ করতে তাদের কিচ্ছু যায় আসতো না! যারা তাদের কাজে প্রচন্ড পেশাদার ছিল, কাজ হাসিল করার ব্যাপারে বেপরোয়া এবং নিশংস, সুরিকেন (Shuriken) নামক তারকা আকৃতির একটি ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করত নিনজারা এটি ছুড়ে মারা হতো,
আর ছিল ফুকিয়া (Fukiya ) বলে পরিচিত একটি ব্লোওগান পাইপ (Blowgun) ফু দিয়ে ব্যবহার করা হতো এই অস্ত্র, কোন সমস্যা ছাড়াই নিরবে মেরে ফেলত মানুষকে! এছাড়াও আরো কিছু নিজস্ব অস্ত্র ছিল তাদের! এসব অস্ত্রের ব্যবহারে বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হতো, এছাড়াও তাদের বিখ্যাত অস্ত্র ছিল কুসারিগামা (Kusarigama) সাধারণ কাস্তের সাথে শিকল লাগানো এই অস্ত্র যে কী ভয়ঙ্কর তা আমাদের কল্পনারও বাহিরে! জাপানের যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গুপ্তচরবৃত্তি নাশকতায় তারা এক ও অদ্বিতীয় প্রয়োজনে প্রভাবশালী সামন্তপ্রভুদের গুপ্তহত্যা ও করতো তারা, জাপানের ইডো যুগে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসে এবং সামন্তবাদ অবক্ষয়ের পর জাপানে আধুনিকতা সুজিত হতে থাকে ফলে নিনজা অধ্যায়ের ও সমাপ্তি ঘটে! তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত জানার মতো তথ্য উপাত্ত পাওয়া গেছে খুব সামান্যই! সে কারণে নিজেদের নিয়ে কল্পকাহিনী ডালপালা বেশি ছড়িয়েছে, যদিও আজো সিনেমা ও কমিক বইয়ে নিনজারা বহাল তবিয়তে টিকে রয়েছে, বর্তমানে সেই পুরনো নিনজারা আর নেই! হাতেগোনা কয়েকজন নিনজা জাপানে টিকে ছিল কয়েক বছর আগেও তবে বর্তমানে জিনসি কাওআমিকেই Jinichi Kawakami (川上仁一) একমাত্র জীবিত নিনজা বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে!
মজার একটা তথ্য দিয়ে শেষ করি ইগারিও নিনজা নামক জাদুঘরটি (The Ninja Museum of Igaryu) নিনজাদের ইতিহাস ধরে রাখার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়, এটি জাপানের রাজধানী টোকিও থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ইগা শহরে অবস্থিত! এ শহরে দুটি বিখ্যাত নিনজা গোষ্ঠীর বসবাস! এখানকার মাইন বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৭ সালে বিশ্বের প্রথম নিনজা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে, পরের বছর ২০১৮ সালে এখানে নিনজার উপর স্নাতক বিষয় খোলা হয় কিন্তু সেখানে সম্প্রতি চুরি হয়েছে আর ধারণা করা হচ্ছে চুরি ও করেছিলেন নিনজারাই! গভীর রাতে নিনজাদের মত নিঃশব্দে এসেছিল তারা, অন্ধকারে মিশে তাদের যাওয়া আসার বিষয়টি প্রথমে কেউ টেরই পাইনি! মাত্র তিন মিনিটের মধ্যে টাকা ভর্তি দেড়শ কেজি ওজনের একটি সিন্দুক নিয়ে উধাও হয়ে যায় তারা, ওই সিন্দুকে ১০ লাখ ইউয়ান (Yuan) বা ৮ লাখের বেশি কিছু টাকা ছিল, যেই ১১০০ জন দর্শনার্থী জাদুঘর এসেছিল তাদেরই টিকিট বিক্রির টাকা ছিল, ভাবুনতো অবস্থাটা ! আজ এই পর্যন্তই কেমন লাগলো কমেন্ট করে জানাতে পারেন দেখা হচ্ছে পরবর্তী ব্লগে! এতক্ষণ সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ!