পৃথিবীর ইতিহাসে সমস্ত শক্তিশালী জীবের উদ্ভবের সাথে সাথে তাদের ধ্বংসের কথা বর্ণিত আছে ডাইনোসরদের ক্ষেত্রেও এর কোন ব্যতিক্রম ঘটেনি!
ডায়নাসোর শব্দটির সাথে কমবেশি আমরা সকলেই পরিচিত, শব্দটি মনে হতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটি বিশালদেহী জন্তুর, ডাইনোসর নিয়ে যেন জানার আগ্রহের কোনো শেষ নেই এক সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বিশাল আকৃতির এবং শক্তিশালী এ জন্তুটি পৃথিবীতে বিচরণ করেছিল প্রায় ১৬৫ মিলিয়ন বা ১৬.৫ কোটি বছর যাবত, পৃথিবীতে ডাইনোসরের উদ্ভব হয় ২৩০ মিলিয়ন বা ২৩ কোটি বছর পূর্বে, ৬৫ মিলিয়ন বা ৬.৫ কোটি বছর পূর্বে এর বেশিরভাগ প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটে। অনেক বেশি সময় ধরে সবচেয়ে শক্তিমান প্রাণী হিসেবে তারা পৃথিবীতে রাজত্ব করে, কিন্তু সর্বোচ্চ শক্তিমানদের ও শেষ পর্যন্ত শেষ রক্ষা হয়নি যদিও পৃথিবীর আবহাওয়া ছিল মনোরম এবং পর্যাপ্ত খাদ্য কোন অভাব ছিল না তবুও আজ থেকে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি বছর আগে ডাইনোসর এর জন্য বেজে উঠেছিলো মৃত্যুর ঘন্টা, কি এমন ঘটেছিল সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে যা ডাইনোসরদের পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে দিয়েছিল এটা জানতে হলে আমাদেরও ফিরে যেতে হবে সাড়ে ৬ কোটি বছর পিছনে!

সূর্যের পরিমিত আলো সমুদ্র থেকে আগত ঠান্ডা বাতাস, পর্যাপ্ত খাবার অর্থাৎ বেঁচে থাকার অনুকূল পরিবেশে ডাইনোসর পৃথিবীতে রাজত্ব করছিল তাদের প্রবল দাপটে অন্যান্য প্রাণীরা অর্থাৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীর ছিল অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত মাটির নিচে বসবাস করত তারা আকারে বৃহৎ হলেও সরীসৃপবর্গের অন্তর্ভুক্ত প্রাণী, এরা ডিম প্রসব করে বংশবিস্তার করতো সুতরাং বেঁচে থাকার জন্য ডাইনোসরদের আলাদা করে কোনো লড়াই করতে হয়নি, কিন্তু মহাবিশ্বের খামখেয়ালীপনার হাত থেকে কারো নিস্তার নেই তাই যখন ডাইনোসর পৃথিবীতে তাদের সুখের জীবন অতিবাহিত করছে তখন মহাবিশ্বে হঠাৎই নেমে এলো প্রলয়ের আশঙ্কা পৃথিবী থেকে প্রায় ২০ কোটি মাইল দূরে মঙ্গল আর বৃহস্পতি গ্রহের ঠিক মাঝখানে ঘুরতে থাকা একটি গ্রহাণু বিপরীত দিক থেকে প্রবল বেগে ছুটে আসা অন্য একটি ছোট গ্রহাণুর সাথে ধাক্কা খায় এর ফলে বড় গ্রহাণুটি ভারসাম্য হারিয়ে প্রতি ঘন্টায় ২২ হাজার মাইল বেগে পৃথিবীর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে, তারপর ধীরে ধীরে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে, বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে ঘর্ষণজনিত বলের কারণে গ্রহাণুটি একটি জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডে পরিণত হয় এবং এর গতিবেগো বেড়ে যায় কয়েক হাজার গুণ, মাত্র সাড়ে চার মিনিটে গ্রহাণুটি আটলান্টিক মহাসাগরকে অতিক্রম করে, পৃথিবীতে আছড়ে পড়ার আগেই গ্রহাণুটির প্রচন্ড আলোর কিরণে পৃথিবীর হাজার প্রাণী তাদের দৃষ্টিশক্তি হারায়,

কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রহাণুটি মেক্সিকোর মাটিতে আছড়ে পড়ে এবং প্রচন্ড শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটায়, এই বিস্ফোরণটি ছিল অন্তত দশটি হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণের সমান, বিস্ফোরণের সাথে সাথে পৃথিবীর উষ্ণতা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫০০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং বিস্ফোরণের ফলে ১৮০ কিলোমিটার চওড়া এবং ২০ কিলোমিটার গভীর একটি গর্তের সৃষ্টি হয় এই ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্টি হওয়া গর্তটির সমস্ত ধাতু এবং পাথর ধুলোয় পরিণত হয় আর আকাশে ধুলোর মেঘ সৃষ্টি করে বিস্ফোরণের কিছুক্ষণ পর পৃথিবীতে প্রচন্ড ভূকম্পন সৃষ্টি হয় ভূকম্পনের ফলে একদিকে সমুদ্রে সৃষ্টি হয় জলোচ্ছ্বাস অন্যদিকে সমস্ত সক্রিয় আগ্নেয়গিরি জেগে ওঠে শুরু করে অগ্ন্যুৎপাত, একই সাথে শুরু হয়েছে ডাইনোসর নিধনযজ্ঞ, এই বিস্ফোরণের ফলে উদ্ভূত শক্তির বিকিরণের মাত্রা এতটাই প্রবল ছিল যে এর ৮০০ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা সমস্ত জীব দেহ পুড়ে ছাই হয়ে যায়, স্থলভাগে বাস করা প্রায় সমস্ত ডাইনোসরদেরেই ধীরে ধীরে মৃত্যু ঘটে, ডানাওয়ালা ডাইনোসররা এই বিকিরণের হাত থেকে রক্ষা পেলেও মৃত্যুর কবল থেকে নিষ্কৃতি পায়নি,

বিস্ফোরণের ফলে যে লক্ষ লক্ষ টোন ধাতু এবং পাথর বায়ুমণ্ডল ভেদ করে আকাশে পৌঁছে গিয়েছিল- বিস্ফোরণের ঠিক ৪০ মিনিট পর মধ্যাকর্ষণের টানে সেগুলো জলন্ত অগ্নি
গোলকের মতো পুনরায় পৃথিবীতে বর্ষিত হতে থাকে অন্যদিকে বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট ধুলোর মেঘ প্রতি ঘন্টায় ৬০০০ কিলোমিটার বেগে পৃথিবীতে আছড়ে পড়ে এবং পৃথিবীতে সূর্যরশ্মিকে পৌঁছাতে বাধা দেয় ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরো বেশি বেড়ে যায়, পৃথিবীর সমস্ত জীবদেহ ছাইতে রূপান্তরিত হয়, প্রাণী ও উদ্ভিদ নির্বিশেষে সকলের মৃত্যু ঘটে, পৃথিবী একটি মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় এরপরেও আশ্চর্যজনকভাবে যে সমস্ত প্রাণী জীবিত ছিল খাদ্যাভাবে তাদের মৃত্যু ঘটে এখন মনে করা যাক সেই সমস্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীদের কথা যারা ডাইনোসরদের ভয়ে মাটির নিচে বসবাস করত এবং যে কোন প্রকারের খাবার খেয়ে জীবন ধারণ করতো এরা আকারে ছিল খুবই ছোট তাই গ্রহাণুর ওই প্রচন্ড বিস্ফোরণ এদের তেমন কোন ক্ষতি করতে পারে নি বরং বিস্ফোরণের ফলে এরা লাভবান হয় পৃথিবী থেকে ডাইনোসর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পর স্তন্যপায়ী প্রাণীদরা এদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে বিস্ফোরণের কয়েক লক্ষ বছর পর অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৪ কোটি ৭০ লক্ষ বছর আগে পৃথিবী আবার ধীরে ধীরে শান্ত হয় পৃথিবীর উষ্ণতা কমে দাঁড়ায় ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং উদ্ভিদজগতেরো বিস্তার ঘটে, আজকের পৃথিবী আর সে যুগের পৃথিবীর পার্থক্য খুব বেশি ছিল না পাত চলাচল ও সংঘর্ষের ফলে বহু পর্বত এবং নদ-নদীরও সৃষ্টি হয়েছিল শুধু অভাব ছিল একটি জিনিসেরই তাহলো আমরা অর্থাৎ মানুষ!
