আমাদের মহাবিশ্ব ঠিক কতটা বড়!


 আমাদের মহাবিশ্বের প্রকৃত আকার বোঝার জন্য আমরা সবাই আগ্রহী কারণ মহাবিশ্বের তুলনায় পৃথিবী অতি ক্ষুদ্র কিন্তু তবুও আমরা সবাই বলে থাকি যে আমাদের মহাবিশ্ব হল একটি বিশাল বড় জায়গা কিন্তু আমাদের এই মহাবিশ্ব ঠিক কতটা বড় এবং কিভাবে তা জানবো আমরা আসুন জেনে নেওয়া যাক আমাদের মহাবিশ্ব ঠিক কতটা বড়।

যতক্ষণ আপনি লেখাগুলো পড়লেন এতক্ষণে সূর্য থেকে নির্গত একটি ফোটন (Photon) কণা ইতিমধ্যেই ১০ মিলিয়ন কিলোমিটার অর্থাৎ এক কোটি কিলোমিটার পথ পরিভ্রমণ করে ফেলেছে যা পৃথিবীর চারিদিকে ২৫০ বার পরিভ্রমণ করার সমান সূর্য ছাড়া আমাদের সবচেয়ে নিকটতম নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টরাই (Proxima Centauri) থেকে নির্গত আলোর চার বছর সময় লাগে পৃথিবীতে এসে পৌঁছাতে সুতরাং আমরা বলতে পারি যে নক্ষত্রটি ৪ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এখন যদি আপনি প্রক্সিমা সেন্টরাই এর দিকে তাকান তাহলে আপনি নক্ষত্রটিকে তার বর্তমান অবস্থায় দেখতে পাবেন না, আপনি নক্ষত্রটি চার বছর আগে যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায় দেখবেন আমরা মহাবিশ্বের কোনো কিছুতেই তার বর্তমান অবস্থায় দেখি না বরং তারা অতীতে যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায় দেখি এবং আমরা তাদের কতটা অতীতে দেখি সেটা নির্ভর করে পৃথিবী থেকে তার দূরত্বের উপর এর কারণ হলো আমাদের সৌরজগতের বাইরে সবকিছুই এতটাই দূরে অবস্থিত যে তাদের আলো পৃথিবীতে এসে পৌঁছাতে অনেক সময় লেগে যায় আমরা সবাই জানি যে আলোর গতিবেগ হল প্রতি সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার এবং এই গতিবেগে ভ্রমণ করেও আমাদের সবচেয়ে নিকটতম নক্ষত্র থেকে নির্গত আলোর ৪ বছর সময় লেগে যায় পৃথিবীতে এসে পৌঁছাতে সুতরাং ভেবে দেখুন যে অন্যান্য নক্ষত্র এবং ছায়াপথগুলো যাদের থেকে নির্গত আলোর পৃথিবীতে এসে পৌঁছাতে লক্ষ লক্ষ বছর লেগে যায় তারা ঠিক কতটা দূরে অবস্থিত সুতরাং এই জন্যেই আমরা তাদের অতীতের অবস্থানে দেখি বর্তমানে না উদাহরণ স্বরূপ আমাদের সবচেয়ে নিকটতম ছায়াপথ অর্থাৎ অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি Andromeda Galaxy (M31) এতটাই বড় যে ছায়াপথ খালি চোখেই দেখা যায়।
এখন আমি ছায়াপথ থেকে খালি চোখে দেখার কথা বলতে আপনি হয়তো ভাবছেন যে পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব সত্যিই অনেকটা কম আসলে আপনি যা দেখছেন তা হলো আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের মতোই কোটি কোটি নক্ষত্রের একটি শহরকে একত্রে একটি আলোর উৎস হিসাবে এবং এই নক্ষত্রের শহরটি ২.৫ মিলিয়ন অর্থাৎ ২৫ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত যার অর্থ হলো আপনি অ্যানড্রোমিডা ছায়াপথ কে ২৫ লক্ষ বছর আগে যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায় দেখছেন পুরো মহাবিশ্ব টাই  অ্যানড্রোমিডা ও আকাশগঙ্গা ছায়াপথের মতোই অসংখ্য ছায়াপথ দ্বারা পরিপূর্ণ কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে নক্ষত্রের বা ছায়াপথের দূরত্ব কিভাবে নির্ণয় করা সম্ভব রাতের আকাশ এই সমস্ত দৃশ্যমান নক্ষত্র সহ আরো কোটি কোটি নক্ষত্র আকাশগঙ্গা ছায়াপথের বাসিন্দা এবং তাদের দূরবর্তী অবস্থানের কারণে তাদের উজ্জ্বলতা অনেক কম হয় সুতরাং তারা খালি চোখে দৃশ্যমান নয় অর্থাৎ কোন নক্ষত্র যত দূরে অবস্থিত তাকে ততই অনুজ্জ্বল মনে হয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এটাকে দূরবর্তী নক্ষত্রের দূরত্ব নির্ণয়ের সূত্র হিসেবে ব্যবহার করে কিন্তু এটা একটা খুব বড় প্রশ্ন তুলে ধরে এবং তা হলো কিভাবে আমরা জানবো যে একটি অনুচর নক্ষত্র সত্যিই খুব দূরে অবস্থিত? নাকি নক্ষত্রটি কম উজ্জ্বলতার হওয়ার কারণে তাকে অনুজ্জ্বল দেখাচ্ছে? এই সমস্যাটির সমাধান হয়েছিল ১৯০৮ সালে যখন Henrietta Leavitt  কিছু নির্দিষ্ট নক্ষত্রের Wattage  বলার উপায় আবিষ্কার করেছিলেন, যে নক্ষত্র গুলি  তাদের Wattage এর সাথে সংযুক্ত পালস রেট পরিবর্তন করে এর দ্বারা আকাশগঙ্গা ছায়াপথের সমস্ত প্রান্তে অবস্থিত নক্ষত্রের দূরত্ব পরিমাপ করা সম্ভব হয়েছিল কিন্তু ছায়াপথের দূরত্ব নির্ণয় করা খুবই কষ্টকর আমাদের মহাবিশ্বে কোটি কোটি ছায়াপথে অবস্থান যাদের মধ্যে সবচেয়ে দূরবর্তী ছায়াপথ গুলি এতটাই দূরে অবস্থিত যে কোটি কোটি বছর আগে সেই ছায়াপথগুলো থেকে নির্গত আলো আজ পৃথিবীতে এসে পৌঁছাচ্ছে যেহেতু আমাদের মহাবিশ্ব ১৩.৮ বিলিয়ান বা প্রায় ১৪০০ কোটি বছর বয়সী সুতরাং সবচেয়ে দূরবর্তী ছায়াপথ গুলির আলো প্রায় ১৪০০ কোটি বছর ধরে ভ্রমণ করে আজ আমাদের পৃথিবীতে এসে পৌঁছাচ্ছে এটা একটা অসাধারণ ঘটনা কারণ আলোর একটি ফোটন কণা কোন একটি দূরবর্তী ছায়াপথ থেকে তার যাত্রা শুরু করার পর যাত্রাতে থাকাকালীন পৃথিবীতে জীবনের সৃষ্টি হয়, ডাইনোসরের আবির্ভাব ঘটে, মানুষের আবির্ভাব ঘটে, আবির্ভাব ঘটে শিল্প বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির, তৈরি হয় হাবল স্পেস টেলিস্কোপের (Hubble Space Telescope) এবং সেই টেলিস্কোপে ফোটন কণা টি তার ১৩.৮ বিলিয়ন বছরের যাত্রা সম্পন্ন করে ধরা পড়ে ছায়াপথগুলো এত দূরবর্তী হওয়া সত্বেও জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সুপার নোভা (Supernova) নামক এক অবিশ্বাস্য উজ্জ্বল নক্ষত্রের বিস্ফোরণের সাহায্যে ছায়াপথগুলোর দূরত্ব পরিমাপ করতে সক্ষম কিছু ধরনের বিস্ফোরিত নক্ষত্রের একটি নির্দিষ্ট উজ্জ্বলতার Wattage আছে যার সাহায্যে তাদের দূরত্ব নির্ণয় করা যায় তাদের বিস্ফোরণের উজ্জ্বলতার পরিমাপ করে এবং এই ভাবেই সেই ছায়াপথের দূরত্ব নির্ণয় করা সম্ভব যে ছায়াপথে সেই বিস্ফোরিত নক্ষত্রটি অবস্থিত আমাদের মহাবিশ্বের সবচেয়ে দূরবর্তী প্রান্ত থেকে আগত আলোর সময় লেগেছে ১৩.৮ বিলিয়ন বছর। একে আমরা Observable Universe বা পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব বলি। যতক্ষণ ধরে এই আলোর ফোটন কণাগুলো মহাবিশ্বে ভ্রমণ করে পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছে ততক্ষণ ধরে আমাদের মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হয়েছে আমরা সেই বিন্দু থেকে সরে গিয়েছি যেখানে আমরা এক সময় অবস্থান করেছি যদিও আলোটি কেবলমাত্র ১৩.৮ বিলিয়ান বা প্রায় ১৪০০ কোটি বছর ধরে ভ্রমণ করেছে তবে যে দূরত্ব থেকে আলোটি আমাদের কাছে এসেছে তা বর্তমানে প্রসারিত হয়ে ৪৬ বিলিয়ন আলোকবর্ষ হয়েছে। অর্থাৎ আমাদের বর্তমান Observable Universe বা পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব হল ৪৬ বিলিয়ন আলোকবর্ষ বা ৪৬০০ কোটি আলোকবর্ষ সুতরাং কতটা বড় আমাদের মহাবিশ্ব? সোজা উত্তর হল কেউই জানেনা মহাবিশ্ব কতটা বড়! মহাবিশ্বকে প্রকৃতপক্ষেই অসীম নাকি এর কোন প্রান্ত আছে? এর কোন প্রকৃত উত্তর নেই! তবে একটা কথা বলা যেতে পারে, যে এই মহাবিশ্ব সত্যিই খুব বড় এবং এতটাই বড় যে এমনকি আলো প্রতি সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কিলোমিটার গতিবেগে ১৪০০ কোটি বছর ধরে ভ্রমণ করার পরও মহাবিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে পৌঁছতে পারেনি এবং এই মহাবিশ্ব সর্বদাই প্রসারিত হয়ে বেড়ে চলেছে সৃষ্টির পর থেকে এবং আমাদের পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব ১৩.৮ বিলিয়ন আলোকবর্ষ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৬ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। ইতিহাস জুড়ে বিভিন্ন প্রজন্মের গবেষক ও অনুসন্ধানকারীরা বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে মহাবিশ্বের গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছেন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ার জন্য এবং আজও এ যাত্রা অব্যাহত রয়েছে বিভিন্ন নতুন পদ্ধতি ও প্রযুক্তির সাথে যা আমাদের প্রতিনিয়ত বিভিন্ন তথ্য আবিষ্কার এর সন্ধান দিচ্ছে হয়তো এভাবেই কোন একদিন আমরা এমন কোন পদ্ধতি বা প্রযুক্তির সৃষ্টি করতে পারব যা আমাদের মহাবিশ্বের বিভিন্ন রহস্য নির্ধারণ করতে এর প্রকৃত আকার বুঝতে সাহায্য করবে আজকের মতো এই পর্যন্তই। তথ্যগুলি পছন্দ হয়ে থাকলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।






Next Post
No Comment
Add Comment
comment url